জীবনানন্দ দাশের শেষ ক'বছরের একান্ত দিনলিপি
"..ধার করেছেন সম্ভাব্য যে-কোনও সূত্র থেকে ; ভাই-বােন-ভ্রাতৃবধু, ইনসিওরেন্স কোম্পানি, স্কটিশ ইউনিয়ন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য-সত্যপ্রসন্ন দত্ত, বিমলাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়, এমনকী প্রতিভা বসু'র কাছ থেকে; শােধ করেছেন লিখে, নগদ কিস্তিতে, খেপে-খেপে ; ভাইএর কাছ থেকে পাওয়া মাসােহারা, লিখে টাকা, সাবলেট-জাত টাকা, টিউশনির ও ইনসিওরেন্স’এর দালালির টাকা — নিয়মিত অর্থাগমের জন্য প্রধানত এ-সব সূত্রের উপর নির্ভর করেছেন, মাঝে-মধ্যে কলেজে চাকরির টাকা, অধিকন্তু। বুদ্ধদেব বসু'র পরামর্শে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়’এর অধ্যাপককে নিজের কবিতা অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন—ডলার বলে কথা! — উত্তর পান নি; নিউ ডিরেকশন নামের প্রখ্যাত মার্কিন প্রকাশন-সংস্থার মালিক কবি জেমস লাফলিনকেও চিঠি লিখে দেখেছেন। 'রবীন্দ্রস্মৃতি' পুরস্কারটা পেলে চাকরি-বাকরিতে সুবিধে হতে পারে, ভেবে দেখেছেন, কিন্তু তার জন্য একটা নতুন কবিতার বই প্রকাশিত হতে হয়, সিগনেট-কে ও পূর্বাশা-কে ঢের ভজিয়েছেন, হয় নি।
এবং শেষপর্যন্ত ট্রামের নিচে চলে গেছেন। কিন্তু, যাবার আগে এ-বিশ্বাসটা গাঢ় ভাবে ধারণ করেছেন যে, যদিও কাটাতে হচ্ছে এখন ‘উইদাউট ফুড’, ভবিষ্যতে কোনও এক দিন ভালাে দিন আসবে, তার লেখার যথার্থ মূল্য নির্ধারিত হবে, কিন্তু সেদিন তিনি এ-ইহধামে থাকবেন না : করুণা প্রার্থনা করতে গিয়ে এ-কথাটা লিখেছিলেন তিনি হুমায়ুন কবির’কে ; লিখেছিলেন, এক জন সামান্য কর্মজীবী অপর মানুষের মতন বেঁচে থাকতে চেয়েছেন তিনি শুধু — পেটে দু’টো ভাত, অঙ্গে এক খণ্ড বস্ত্র এবং মাথার উপরে একটা ছাদ সম্বল করে, তার বেশি কিছু চান নি, তাঁর দেশ তাঁকে এটুকু অন্তত দিক।"
[ ভূমেন্দ্র গুহ, 'শেষ ছ'বছর'-এর ভূমিকা থেকে ]
জীবনের শেষ ছ'বছরে প্রায় কিছুই রচনা করেননি জীবনানন্দ দাশ। বরং খাতায় এলোমেলোভাবে লিখে গেছেন কর্জের হিসেব, মুদিখানার ধারবাকি বা আর কার থেকে টাকা ঋণ নিতে পারেন, তার তালিকা। কিছু চিঠির মুসাবিদা (যা কোনোদিন পোস্ট করা হবে না) কিংবা নতুন কাব্যগ্রন্থের সূচিপত্রের খসড়া (যা কোনোদিন প্রেসের মুখ দেখবে না)। ক্ষয় হয়ে যাওয়া এক দিশাহারা জীবনের একান্ত দিনলিপি তাঁর শেষ ছ'টি খাতা - যা প্রতিক্ষণ ২০০৯-এ প্রকাশ করেছিল অবিকৃত পান্ডুলিপি হিসাবেই, দু'খন্ডে। অবিন্যস্ত সে অক্ষরমালায় আঙুল ছোঁয়ালেই যেন কবির সেই অস্থির সময়পর্বের যন্ত্রণা আচ্ছন্ন করে পাঠককে।
১৯৪৮ আর '৫৪-র দুটি খাতার ভূমেন্দ্র গুহ-কৃত টীকার অংশ বাদ দিলে পুরো বইটিই খাতাগুলির প্রতিটি পৃষ্ঠার (কোনো কোনোটি তার দুষ্পাঠ্যও বটে) অবিকল প্রতিচিত্রণ, মুদ্রিত পাঠান্তর নয়। জীবনানন্দপ্রেমীদের জন্য এ এক অবিশ্বাস্য সংগ্রহ, আর সন্ধিৎসূ গবেষকের কাছে প্রায় অচেনা জীবনানন্দকে বুঝে ওঠার এক আকর বই।
Comments